দুবাইর জুমেইরা বিচ বিশ্বের ধনীদের আকর্ষণীয় গন্তব্য। কৃত্রিমভাবে তৈরি খেজুর গাছ আকৃতির দ্বীপের হোটেল ও রিসোর্টগুলো মিলিওনিয়ারদের যেন চুম্মকের মতো টানে। তারা যে শুধু অবসর যাপন করতেই সেখানে যান তাই নয় বরং বিলাসবহুল ভবন বা অ্যাপার্টমেন্ট কিনে অনেকেই সেখানে স্হায়ীভাবে বসবাস করছেন। কেবল জুমেরাই বিচ নয়, দুবাই জুড়েই রয়েছে এরকম আরো অনেক হোটেল, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভিলা।
এসব অ্যাপার্টমেন্ট ও ভিলাগুলোর মালিকদের অনেকেই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ। আছেন প্রাদেশিক গভর্নর এবং পরমাণু শক্তি কেন্দ্রের ব্যবস্হাপকরাও। এছাড়া অন্যান্য ব্যবসায়ী, সাবেক সিনেটর এবং একজন বেলারুশ টোবাকো শিল্পপতি বসতি গেড়েছেন সেখানে।
জানা গেছে, পুতিন ঘনিষ্ঠ অন্তত ৩৮ জন ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তা দুবাইতে ঠিকানা তৈরি করেছেন। এদের মালিকানাধীন সম্পদের পরিমাণ ৩১৪ মিলিয়ন ডলারের বেশি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো যেসব রুশ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে এমন অন্তত ছয় জন কর্মকর্তা ঐ তালিকায় আছেন। এছাড়া আরেক জন কর্মকর্তা আছেন যার সেখানে বাড়ি না থাকলেও একটি বিলাসবহুল ইয়ট কিনে রেখেছেন। এ সব কর্মকর্তারা এখন নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করছেন।
ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর থেকেই নির্দিষ্ট সংখ্যক রুশ কর্মকর্তা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নেমে আসে নিষেধাজ্ঞার খড়গ। সুইজারল্যান্ড থেকে শুরু করে মোনাকো ও কেইম্যান আইল্যান্ডয়ের ব্যাংকগুলো এখন তাদের অ্যাকাউন্ট ও বিষয় সম্পত্তির খবর নিতে শুরু করেছে। তবে দুবাইতে থাকা রুশ ধনকুবেররা এই ঝামেলা থেকে বেঁচে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশটি সাম্প্রতিক সময়ে রুশ ধনকুবেরদেরও অন্যতম বিচরণ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। কারণ সেখানে অর্থের উত্স সম্পর্কে উচ্চবাচ্চ্য করা হয় না। তবে ইউক্রেনে হামলার পর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হওয়ায় দুবাইতে রুশদের সামান্য জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তবে সেটা তাদের জন্য গুরুতর কোনো সমস্যা হবে না। মার্কিন অর্থ দফতরের সাবেক উপদেষ্টা ও আইনজীবী অ্যাডাম এম স্মিথ মনে করেন, নিষেধাজ্ঞা একটি শক্তিমালী হাতিয়ার হলেও এর দুর্বল দিকও রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর কোনো একটি আর্থিক কেন্দ্র যদি তা বাস্তবায়নে গড়িমসি করে তবে এর ফল ঠিকমতো পাওয়া যাবে না।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই যে উন্নাসিকতা তার একটি প্রভাব উপসাগরীয় অন্যান্য মিত্র দেশের ওপরও পড়তে পারে। লক্ষ্যণীয় যে ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়ার বিরুদ্ধে এই দেশগুলো নিন্দা জানায়নি। আমিরাত, সৌদি আরব ও মিসরের মধ্যে বরং রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
মিসর একটি পরমাণু শক্তি কেন্দ্র তৈরির জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে ২৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের আলোচনা চলছে। ব্রাসেলসভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইউএস প্রোগ্রামের পরিচালক মাইকেল হান্না বলেন, ‘এটি হতে পারে একটি সন্ধিক্ষণ। পরিস্হিতি যে কোনো দিকে গড়াতে পারে।’
বিশ্লেষকদের মতে, ২০১৫ সালে মার্কিন উদ্যোগে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি সম্পাদনের পর থেকেই তেল সমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের দূরত্ব হওয়া শুরু হয়।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা যে আমিরাত গুরুত্ব সেটি আরেকটি কারণে প্রণিধানযোগ্য। দেশটি এখন নিরাপত্তা পরিষদের পর্যায়ক্রমিক সদস্য। কিছুদিন আগে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের নিন্দা প্রস্তাব বা রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাবে ভোট দানে বিরত ছিল আমিরাত। দেশটির কর্মকর্তারা রাশিয়াকে এই বলে নিশ্চয়তা দিয়েছে যে জাতিসংঘ যদি তাদের বিরুদ্ধে কোনো নিষেধাজ্ঞা প্রস্তাব পাস করে তবেই তারা সেটি অনুসরণ করবে। তবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের কোনো নিষেধাজ্ঞা প্রস্তাব পাস করানো কার্যত অসম্ভব কারণ সে রকম কোনো প্রস্তাব এলে রাশিয়া ভেটো দিয়ে দিয়ে সেটা নাকচ করে দেবে।
আমিরাতের শাসকদের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক আব্দুল খালেক আব্দুল্লাহ বলেছেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন না করা পর্যন্ত কেউ আমাদের দোষ দিতে পারবে না। বর্তমান পরিস্হিতি পশ্চিমা দেশগুলো যেভাবে আমাদের সমালোচনা করছে বা আমাদের কর্মকাণ্ড সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখছে সেটি কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নয়।’
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর অ্যাডভান্স ডিফেন্স স্টাডিজের দেওয়া তথ্য মতে, দুবাইতে পুতিন ঘনিষ্ঠ অন্তত ৭৬ জনের সম্পত্তি আছে। বিশেষ করে ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর সেখানে অ্যাপার্টমেন্টের দাম বেড়ে গেছে। রুশ ব্যবসায়ীরা দুবাইয়ের বর্তমান ভূমিকায় সন্তুষ্ট। কারণ বর্তমানে রুশ পাসপোর্ট বা মুদ্রা নিয়ে দেশে দেশে সফরে যাওয়ার সুযোগ তাদের সামনে নেই বললেই চলে। আমিরাত পশ্চিমাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায় রুশ ব্যবসায়ীদের জন্য এটি এক বাড়তি সুযোগ।